শাহীন মাহমুদ রাসেল

 

কক্সবাজারের টেকনাফ থানার মালখানাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে একটি ভয়াবহ ‘ইয়াবা এক্সচেঞ্জ’ সিন্ডিকেট। অভিযোগ উঠেছে- থানার ওসি গিয়াস উদ্দিন ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী এসআই ননি বড়ুয়ার নেতৃত্বে জব্দ ইয়াবা সরিয়ে ভেজাল কিংবা নকল ইয়াবা জমা রাখার ভয়ঙ্কর অপকর্ম চলছে। স্থানীয়দের ভাষায়, এটি এখন ‘মালখানার নামে ইয়াবার গুদাম’।

 

বিশ্বস্ত সূত্রের বরাতে জানা গেছে, র‌্যাব, বিজিবি বা অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে জব্দ করা আসল ইয়াবা থানায় জমা হওয়ার পর তা গোপনে সরিয়ে ফেলা হয়। এরপর মালখানায় স্থান পায় নিম্নমানের কিংবা নকল ইয়াবা। নমুনা হিসেবে মাত্র কয়েকটি পিস পাঠানো হয় পরীক্ষাগারে। এতে মূল ইয়াবার গুণগত মান যাচাইয়ের সুযোগ থাকে না।

 

প্রত্যক্ষদর্শী ও থানার একাধিক কর্মকর্তার অভিযোগ, এ অপকর্মে ওসির ‘ক্যাশিয়ার’ হিসেবে পরিচিত এসআই ননি বড়ুয়া সরাসরি জড়িত। তিনি স্থানীয় মাদক সিন্ডিকেটের কাছে ইয়াবা ‘এক্সচেঞ্জ’ করে বিক্রি করেন। প্রতি ১০ হাজার পিস ইয়াবা বদলের বিপরীতে আদায় হয় আড়াই থেকে ৩ লাখ টাকা।

 

একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমরা তদন্ত করি, মামলা লিখি, অথচ ইয়াবা দেখি না। সবই নিয়ন্ত্রণ করে ননি বড়ুয়া। ওসি স্যারের নির্দেশেই এই সিন্ডিকেট চলে।’

 

এ চক্রের প্রভাব এতটাই ভয়াবহ যে, বাবা না পেয়ে সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্রকে অস্ত্র দিয়ে ফাঁসিয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বিষয়টি দেশজুড়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিলো। তারপরও ওসি গিয়াসের কিছুই হয়নি।

 

চলতি বছরের ৬ এপ্রিল জেলা পুলিশ সুপার স্বাক্ষরিত এক আদেশে এসআই ননি বড়ুয়াসহ আটজন কর্মকর্তাকে বিভিন্ন থানায় বদলি করা হয়। তবে ননি বড়ুয়া সেই আদেশ মানেননি। তাকে পেকুয়া থানায় বদলি করা হলেও এখনও তিনি টেকনাফ থানাতেই রয়েছেন।

 

অভিযোগ রয়েছে- ওসি গিয়াস উদ্দিনের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে তিনি নিয়মিত থানায় বসছেন এবং আগের পদমর্যাদার সুবিধা ভোগ করছেন। বদলি ঠেকাতে পুলিশের উচ্চ পর্যায়ে প্রভাব খাটানো এবং মোটা অঙ্কের উৎকোচ লেনদেন হয়েছে বলেও জানায় একাধিক সূত্র।

 

থানার একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘ননি বড়ুয়াকে সরালে পুরো ইয়াবা সিন্ডিকেট ধসে পড়বে- এ কারণেই তাকে রাখার জন্য ওসি গিয়াস সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়েছেন।’

 

স্থানীয়দের ভাষ্য, টেকনাফ থানা এখন ‘ইয়াবার ট্রানজিট হাব’-এ পরিণত হয়েছে। ওসি গিয়াস ও এসআই ননি বড়ুয়ার নেতৃত্বে দুটি ভিন্ন সিন্ডিকেট সক্রিয়। একটি সিন্ডিকেটে রয়েছেন- হ্নীলার মুহিবুল্লাহ ও সাইম নামের দুই যুবক, যারা ওসির নির্দেশে ইয়াবা সংগ্রহ ও বিক্রির কাজ করেন। অপরদিকে, ইসলামাবাদের নেজাম উদ্দিন ও সবুর সওদাগরের সঙ্গে এসআই ননি বড়ুয়ার ব্যক্তিগত সিন্ডিকেটও সক্রিয়। নিয়মিত গভীর রাতে তারা একটি নির্দিষ্ট স্থানে বৈঠকে বসেন- যেখানে ইয়াবা লেনদেনের হিসাব-নিকাশ হয়।

 

এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘প্রশাসনের অভিযান শুরু হলেই এই সিন্ডিকেটের লোকজন আগে থেকেই নকল ইয়াবা এনে মজুদ করে রাখে।’

 

টেকনাফ থানায় দায়ের হওয়া বেশিরভাগ মাদক মামলার তদন্ত কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন- তারা নিজেরা ইয়াবা দেখেন না। সবকিছুই এসআই ননি বড়ুয়ার নিয়ন্ত্রণে।

তারা বলেন, ‘ল্যাবে মাত্র কয়েক পিস পাঠানো হয়। বাকি ইয়াবা ননির হেফাজতেই থাকে। ফর্মে লেখা হয় ১০ হাজার পিস, কিন্তু আসলেই কত জমা পড়েছে; সেগুলো আসল কিনা নকল তাও নিশ্চিত নয়।’

 

এই অবস্থায় থানা থেকে আদালতে পাঠানো মাল পরীক্ষা না হওয়ায়, নকল ইয়াবা ধ্বংসের সুযোগ থেকেই যায়।

কক্সবাজার জেলা জজকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট আব্দুল মান্নান অভিযোগ করে বলেছেন, ‘উখিয়া-টেকনাফে সাব-ইন্সপেক্টর (এসআই) পদে পোস্টিং পেতে নাকি ১ কোটি টাকার লেনদেন হয়- এমন জনশ্রুতি রয়েছে।’ তার মতে, এই কারণেই তারা মাদক নিয়ে নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে।

তিনি বলেন, ‘যে কয়েকটি ইয়াবা ট্যাবলেট পরীক্ষার জন্য ল্যাবে পাঠানো হয়, কেবল সেগুলোরই রাসায়নিক বিশ্লেষণ হয়। বাকি ইয়াবাগুলো কোর্টে জমা দেওয়ার সময় আলাদাভাবে পরীক্ষার কোনো সুযোগ নেই। ফলে ‘এক্সচেঞ্জ’ বা ইয়াবা বদল করে মূল মাল গায়েব করার যথেষ্ট সুযোগ থেকে যায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘থানা থেকে যেভাবে মাল পাঠানো হয়, আদালতে তা-ই ধ্বংস করে দেওয়া হয়। মাঝখানে কেউ চ্যালেঞ্জ না করলে থানা-পুলিশ যা পাঠায়, সেটাই ধ্বংস হয় ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে। যদি প্রতিটি পিস ইয়াবা আদালতে গ্রহণের সময় পরীক্ষা করা হতো, তাহলে এই ধরনের চুরি বা প্রতিস্থাপনের সুযোগ থাকতো না।’

ওসি গিয়াস ও এসআই ননি বড়ুয়ার বিরুদ্ধে স্থানীয়দের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে। তবে অধিকাংশই মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না।

সাবেক এক ইউপি সদস্য বলেন, ‘ওসি গিয়াস ইয়াবা বিক্রির টাকা দিয়ে প্রশাসনের উপর মহলকে খুশি রাখেন। তাই বদলির আদেশও তার সামনে টিকতে পারে না।’

এক রিকশাচালক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘সাধারণ মানুষকে হয়রানি করে পুলিশ কোটি টাকার মাদক ব্যবসা চালায়। এতে আইনশৃঙ্খলা বলার কিছুই থাকে না।’

স্থানীয়দের দাবি, ইয়াবা এক্সচেঞ্জ নিয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত জরুরি। না হলে ‘মালখানা’ আর ‘মালচোর’দের আড়ালে নিরাপত্তার সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে উঠবে ইয়াবা সিন্ডিকেট।

বদলির আদেশ কার্যকর না হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এএসপি) ও জেলা পুলিশের মুখপাত্র জসিম উদ্দিন বলেন, ‘ননি বড়ুয়ার বদলির বিষয়টি জানতাম না। কিছুদিন সময় দিন, আমি ব্যবস্থা নিচ্ছি।

দু’সপ্তাহ পর যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, বদলি হয়েছিল। তবে তিনি এসপি স্যারের কাছে আবেদন করে আদেশ স্থগিত করেছেন।’

এ বিষয়ে জেলা পুলিশ সুপার সাইফউদ্দীন শাহীন কিংবা অতিরিক্ত ডিআইজি (ক্রাইম ম্যানেজমেন্ট) ওয়াহিদুল হক চৌধুরীর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও সাড়া মেলেনি।

তবে অতিরিক্ত ডিআইজি ওয়াহিদুল হক চৌধুরী জানিয়েছেন, ‘বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। অভিযোগের সত্যতা মিললে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *