
মো: মিজবাহ উদ্দীন ইবাদ: চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ইছামতি নদী বছরের পর বছর ধরে স্থানীয় মানুষের জীবন-জীবিকা কেড়ে নিচ্ছে। নদীভাঙনে প্রতিনিয়ত গ্রাস হচ্ছে বসতবাড়ি, চাষের জমি, কবরস্থান এমনকি সড়কপথও। গত ২১আগষ্ট,২০২৫ইং প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থীর ফিল্ডওয়ার্কের তথ্য বলছে, নদীভাঙনে (Diluvion) স্থায়ীভাবে গ্রাম হারিয়ে যাচ্ছে, আবার একই নদীতে চর জেগে (Alluvion) নতুন জমি সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সেই জমি প্রকৃত ভুক্তভোগীদের কাছে পৌঁছায় না।
আইন আছে, কিন্তু প্রয়োগ নেই
বাংলাদেশে নদীভাঙন ও জমা হওয়া জমি নিয়ে আইনগত কাঠামো বেশ পুরনো হলেও স্পষ্ট। Bengal Alluvion and Diluvion Regulation, 1825, Bengal Tenancy Act 1885, Alluvial Lands Act 1920 এবং State Acquisition and Tenancy (SAT) Act 1950–এ নদীর কারণে জমি হারানো ও নতুন জমি সৃষ্টি হওয়ার ক্ষেত্রে মালিকানা নিয়ে সুস্পষ্ট বিধান আছে। তত্ত্ব অনুযায়ী, ধীরে ধীরে জমা হওয়া জমি মূল জমির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কথা এবং জমি হারালে মালিকের অধিকারও হারিয়ে যায়। কিন্তু মাঠপর্যায়ে দেখা যায়, নতুন জমি সরাসরি সরকারের নামে “খাস জমি” হিসেবে রেকর্ড হয়।
এ ব্যাপারে ভূমি অফিসের কর্মকর্তারা জানান, “নতুন চর জেগে উঠলে তা সরকারের নামে রেকর্ডভুক্ত হয় এবং পুনর্বাসন প্রকল্পে ব্যবহার করা হয়।” তবে সাধারণ মানুষ কোনো ধরনের সরকারি ঘোষণা বা বিজ্ঞপ্তি পান না। ফলে স্থানীয়দের মনে তৈরি হয় অনিশ্চয়তা ও ক্ষোভ।
ভুক্তভোগীদের দুঃখগাথা
রাঙ্গুনিয়ার রোউজারহাট এলাকায় ভুক্তভোগীদের সাথে কথা বলে জানা যায় ভয়াবহ বাস্তবতা—
মো. তৈয়ব, এক রিকশাচালক, অভিযোগ করেন: “বাঁধ ভেঙে ঘরবাড়ি নদীতে চলে গেল, কিন্তু কোনো সরকারি সাহায্য পাইনি। নতুন চর জেগেছে, কিন্তু সেটা আমাদের হাতে আসেনি।”
সুমি আক্তার, খাস জমিতে বসবাসরত এক গৃহকর্মী, নদীভাঙনে একাধিকবার ঘর হারিয়েছেন। তিনি বলেন, “আমরা চর জমিতে বাড়ি বানালেও যেকোনো সময় তা ভেঙে যায়। ভাতা বা সাহায্য পেতে হলে ঘুষ দিতে হয়।”
দিলুয়ারা বেগম, এক বিধবা নারী, জানান তিনি চার বছর ধরে বিধবা ভাতা পাননি। কর্মকর্তারা ঘুষ দাবি করায় তিনি আর আবেদন করেননি। পানি ও স্বাস্থ্যসেবার অভাবে তার পরিবার প্রতিদিন নতুন কষ্টের মুখোমুখি হচ্ছে।
সেলিনা রহমান, স্থানীয় আরেক ভুক্তভোগী, বলেন পাহাড়ি ঢলের কারণে রাস্তা ভেঙে যাওয়ায় পুরো গ্রাম বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। সরকারি উদ্যোগ না পেয়ে গ্রামবাসী নিজেরাই চাঁদা তুলে রাস্তা মেরামত করেন।
প্রশাসনিক সীমাবদ্ধতা
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অফিস জানায়, চর জমি খাস জমি হিসেবে রেকর্ড করা হয় এবং তা ভাঙনবাসীদের পুনর্বাসনে ব্যবহার করার চেষ্টা থাকে। তবে ভুক্তভোগীরা দাবি করেন, এসব জমি প্রভাবশালীদের হাতে চলে যায়, আর প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা বঞ্চিত হন।
গবেষণা ও মানচিত্র বিশ্লেষণ
ভূমি অফিসে পাওয়া রেকর্ড অনুযায়ী, ইছামতি নদীর কিছু এলাকা একসময় ছিল নদীর তলদেশ। পরবর্তীতে সেখানে নতুন চর জেগে উঠে সরকারিভাবে নতুন খতিয়ান তৈরি হয়েছে। তবে সরকারি নথিতে এসব জমি জনগণের কাছে হস্তান্তরের কোনো স্পষ্ট প্রক্রিয়া দেখা যায় না।
বিশেষজ্ঞ মতামত
আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, “বাংলাদেশের আইন যথেষ্ট শক্তিশালী, কিন্তু প্রয়োগ দুর্বল। ডিজিটাল খতিয়ান ও স্বচ্ছ ঘোষণা ব্যবস্থা চালু করা গেলে ভুক্তভোগীরা অন্তত নিজেদের অধিকার সম্পর্কে জানবেন।”
প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সুপারিশ করেন,
নতুন খাস জমি নিয়ে সর্বজনীন ঘোষণা ও স্বচ্ছ লিজ প্রক্রিয়া চালু করতে হবে। ডিজিটাল রেকর্ড নিশ্চিত করে দুর্নীতি ও প্রভাবশালী দখল রোধ করতে হবে। নদীভাঙন এলাকায় টেকসই বাঁধ, সেতু ও রাস্তাঘাট নির্মাণ জরুরি। ভাতা ও ত্রাণ বিতরণে দুর্নীতি বন্ধ করে প্রকৃত ভুক্তভোগীদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। আইন সম্পর্কে জনগণের সচেতনতা বাড়াতে হবে।
ইছামতি নদীর ভাঙন শুধুই একটি পরিবেশগত সমস্যা নয়, এটি একটি সামাজিক, অর্থনৈতিক ও আইনি সংকট। ভাঙনে মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে, আবার নতুন জমি সৃষ্টি হলেও তার সুফল তারা পাচ্ছে না। তাই আইন প্রয়োগের স্বচ্ছতা, দুর্নীতি দমন ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন ছাড়া নদীভাঙন–জমার এই দুষ্টচক্র থেকে মানুষকে মুক্ত করা সম্ভব নয়।