নিজস্ব প্রতিবেদক

শহরের পৌরসভার কুতুবদিয়া পাড়াতে ‘ইয়াবা কুইন’ হিসাবেই পরিচিত রোজিনা আক্তার। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ মাদক কারবারিদের একজন রোজিনা ও তার স্বামী রিয়াজ আহমদ ইলিয়াস প্রকাশ রোহিঙ্গা ইলিয়াস। এ দম্পতির বিরুদ্ধে দুদক, থানা-কোর্টে চলমান রয়েছে একাধিক মামলা। প্রায় ১ যুগের বেশি ধরে মাদক ব্যবসা করে আসা রোজিনা একসময় নারী পাচার ও গাঁজার পুরিয়া বিক্রি করতেন বলে জানান স্থানীয় এলাকাবাসী। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরও যায়নি তার ক্ষমতা ও দাম্ভিকতা। এখনও রেহাই পাচ্ছে না সাধারণ এলাকাবাসী ও তার নির্যাতনের শিকার অসহায় অনেক ভুক্তভোগী বলে স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা যায়।

তার স্বামী রিয়াজ আহমদ ইলিয়াস প্রকাশ রোহিঙ্গা ইলিয়াস হচ্ছেন পৌর আওয়ামী লীগের ১নং ওয়ার্ডের ৮নং ইউনিটির সভাপতি ও সে হচ্ছেন পৌর আওয়ামী লীগের ১নং ওয়ার্ডের মহিলা সম্পাদিকা। মহিলা সম্পাদিকা হলেও কক্সবাজার শহরে রয়েছে তাদের একচেটিয়া মস্তানি নায়কতন্ত্র। সমাজ কমিটি, মাদ্রাসা কমিটি, স্কুল পরিচালনা কমিটি থেকে শুরু করে বিচার-সালিশ পর্যন্ত তারা স্বামী স্ত্রী নিয়ন্ত্রিত করেন। কারণ জেলা শহরে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের যে কোন অনুষ্ঠান বা সভা-সমাবেশে তাদেরই নেতৃত্বে শত শত নারী-পুরুষের অংশগ্রহণ হয়। এসব কর্মীদের আর্থিক জোগান দিতেন এই মহিলা নেত্রী ইয়াবা সম্রাজ্ঞী রোজিনা। তাই আওয়ামী লীগের শীর্ষ স্থানীয় নেতাদের মনিকোঠায় স্থান করে নেয় তাঁরা। এছাড়াও জেলা আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতাসহ ক্ষমতাশালী বেশ কয়েক নেতার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় দিন দিন তার অপরাধের ক্ষমতা বাড়তেই থাকে। কেউ তাদের বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস করে না। যদিওবা কেউ মুখ খুললে-ও হতে হয়েছে নির্যাতনের শিকার বা বিভিন্ন মামলার আসামী। এমনকি এলাকাও ছাড়তে হয়েছে অনেক প্রতিবাদী পরিবারের লোকজন ও পুরো পরিবারের সদস্যদের।

রোজিনা গ্যাংয়ের ব্যাপারে মধ্যম কুতুবদিয়া পাড়ার বাসিন্দারা জানান- একাধিক মামলার আসামি রোজিনা আওয়ামীলীগ সরকার পতনের পরপরই লাপাত্তা ছিলেন কিছুদিন। বর্তমানে সে আবারো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তবে এখন খুব কৌশলে চলাফেরা করেন। এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিভিন্ন তথ্যসূত্রের হিসাব অনুযায়ী, কয়েকটি স্পটে প্রতিমাসে রোজিনা অন্তত কোটি টাকার মাদক বিক্রি করেছেন। বর্তমানে স্থানীয় এক বিএনপির নেতাকে ম্যানেজ করে রোজিনা দক্ষিণ কুতুবদিয়া পাড়াতে অবস্থান করছেন বলে নিশ্চিত করেছে একটি সূত্র।

তারা আরও জানান- এই নারীর অবৈধ ব্যবসার পথে কেউ বাধা হয়ে দাঁড়ালে তাকে প্রতিহত করতে জেলার ও এলাকার স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সক্রিয় অবস্থান দেখা গেছে এবং ঘরবাড়ি-জমিজমা কেড়ে নিয়ে এলাকা থেকে তাড়িয়ে দেওয়াও হয়েছে। কক্সবাজার শহরজুড়ে রয়েছে তার নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী, যারা তার মাদক ব্যবসা থেকে শুরু করে সবকিছুই দেখভাল করে এবং সেল্টার দিয়ে থাকেন। এছাড়া মাদক নিয়ে জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়ের পাশাপাশি ছবি-ভিডিও করে বিভিন্ন জনকে ব্ল্যাকমেইল করার ঘটনা ও হয়েছে। তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসাবে রয়েছে বন্দরপাড়া সমাজ কমিটির সভাপতি দিদারুল আলম দিদার, একান্ত সহযোগী ফয়সাল মোহাম্মদ রায়হান, সে সবসময়ই তাকে মোটরসাইকেলে নিয়ে সরকারী-বেসরকারী ও পত্রিকা অফিসে চলাফেরা করেন। তার দিনের বেশির ভাগ চলে যায় রোজিনার পিছনে। এছাড়া কুতুবদিয়া পাড়া ও নাজিরারটেক এলাকার বদি আলমের ছেলে মোঃ রুবেলসহ আরো একাধিক সদস্য রয়েছে।

এছাড়া অবৈধ সম্পদ অর্জন ও গোপন করার দায়ে কক্সবাজার সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. রিয়াজ উদ্দিন বাদি হয়ে একটি মামলা করা হয়েছে ইয়াবা সম্রাজ্ঞী রোজিনার বিরুদ্ধে। এ মামলায় তার বিরুদ্ধে ২৭ লাখ ৮৯ হাজার ৭৭৭ টাকার সম্পদ অর্জনের তথ্য গোপনসহ জ্ঞাত আয়ের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণভাবে ৪৭ লাখ ৯২ হাজার ২৭৭টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে। কক্সবাজার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, রোজিনার নামে কয়েকটি নিয়মিত মামলাসহ অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া তার অবৈধ ব্যবসার পরিকল্পনাকারী ও কর্ণধার স্বামী ইলিয়াস সহ কয়েকজন সরাসরি জড়িত বলেও জানান।

কুতুবদিয়াপাড়ার স্থানীয় বাসিন্দা জয়নাল আবেদীন প্রকাশ সোনা মিয়া বলেন- রোজিনার পূর্ব ইতিহাস কারো অজানা নেই। তার বিয়ে হয় রোহিঙ্গা নাগরিক ইলিয়াসের সঙ্গে। তারা বনে যান কুতুবদিয়া এলাকার সমাজ সেবক। ভাগিয়ে নেন বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের শীর্ষ নেতা-নেত্রীর পদ। এলাকা ভিত্তিক শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে মাদক ব্যবসার একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণে নেন এই কৌশলী দম্পতি। স্থানীয়দের চোখে ফাঁকি দিয়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও কয়েক নেতার সাথে আঁতাত রেখে দু’জনে মিলে মাদকের একচেটিয়া ব্যবসা করে লাখ লাখ টাকার মালিক বনে যান। তাদের মাদক ব্যবসায় বিভিন্ন স্পটে যুক্ত রয়েছেন একাধিক চক্র। চক্রটির বেশ কয়েক সদস্য গ্রেফতার হলেও বরাবরই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাগালের বাইরে থেকে যায় রোজিনা।

স্থানীয় একটি সূত্রে জানা গেছে- প্রশাসনের নানা স্তরের কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, জনপ্রতিনিধিসহ বিতর্কিত অনেকের সাথে যোগাযোগ রয়েছে রোজিনার। তার বাসায় পুলিশের তিন সদস্যের সাথে হাতাহাতির ঘটনায় ওই তিন পুলিশকে গ্রেফতার ও বরখাস্ত এবং রোজিনাকেও গ্রেফতার করা হয়েছিল। জনশ্রুতি রয়েছে, কতিপয় পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যরাই বিভিন্ন অভিযানে জব্দ করা ইয়াবার চালান হতে ইয়াবা সরিয়ে রোজিনাকে দিয়ে বিক্রি করাতেন। সেই টাকার লেনদেন নিয়েই তিন পুলিশ সদস্যদের সাথে হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছিল। এরপরই রোজিনার অবৈধ ব্যবসার সাথে জড়িত থাকার তথ্য প্রকাশ্যে আসে এবং দুদকের নজরে পড়ে। জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাসহ বেশ কয়েক নেতার শেল্টারে থাকেন বলে নানান অপরাধের অভিযুক্ত রোজিনার বিরুদ্ধে টু শব্দ করতে সাহস করেনি এলাকার ভূক্তভোগী মানুষ। 

জানা যায়- আওয়ামীলীগের ১৬ বছরের শাসনামলে এলাকার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ও জেলা আওয়ামীলীগের পদবিধারী নেতাদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে বিএনপি জামাত নেতাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র এবং এই রোজিনা এলাকার নিরীহ মানুষকে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানিতে লিপ্ত ছিলেন। হয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের উচ্চ পদস্থ নেতার আশীর্বাদপুষ্ট নেত্রী। তারই আশীর্বাদে গড়ে তুলেছেন নিজস্ব সমাজ কমিটি। যে কমিটির নেতৃত্ব থেকে শুরু করে বিচারিক কাজ পর্যন্ত তিনি নিজেই করেন। সেই সমাজে গড়ে তুলেছেন নিজের একনায়কতন্ত্র। এছাড়া ইয়াবা সহ বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য ক্রয়-বিক্রয় আর ইয়াবা ক্রয়ের কথা বলে কৌশলে তার বাড়িতে এনে জিম্মি করে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে অহরহ। জিম্মি করে কেউ পুলিশ আবার কেউ ডিবি হয়ে ইয়াবা সামনে দিয়ে ভিডিও ছবি তুলে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে হাতিয়ে নেন লাখ লাখ টাকা। এখনোও তার হাতে জিম্মি ছবি-ভিডিও মাধ্যমে অনেক প্রভাবশালী। মান সম্মানের ভয়ে এখনো এড়িয়ে চলেন রোজিনাকে। সে প্রকাশ্য এসব কারবার করলেও এলাকায় কেউ মুখ খুলতে সাহস পায়না। কারণ এলাকার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ থেকে শুরু করে তার সমাজে অনেকের পকেটে চলে যায় প্রতিটি কাজের রোজিনার হাদিয়া। (এছাড়া তার প্রকাশ্য এসব ইয়াবা কারবারের ভিডিও ও অডিও কল রেকর্ড প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত)।

এসব বিষয়ে রোজিনার বিরুদ্ধে সচিত্র সংবাদ দৈনিক মেহেদী পত্রিকায় প্রকাশিত হইলে পত্রিকার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনকে মোবাইলে ফোন দিয়ে অসদাচারণ ও অফিসে এসে পত্রিকা পরিচালনা পরিষদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলার হুমকি প্রদান করে। সংবাদ প্রকাশের জের ধরে ২৫ আগস্ট রাত ৮টার সময় দৈনিক মেহেদী পত্রিকার অফিসে এসে পরিচালনা পরিষদ ও ব্যবস্থাপনা সম্পাদক মোঃ নাজিম উদ্দিনের সাথে পত্রিকা অফিসে দেখা করেন অভিযুক্ত রোজিনা আক্তার, সাথে ছিলেন ফয়সাল মোহাম্মদ রায়হান নামে তার এক সহযোগী। সে জেলার একটি পত্রিকার সহকারী সম্পাদক পরিচয় দেন। এ সময় রোজিনা ব্যবস্থাপনা সম্পাদক মোঃ নাজিম উদ্দিন ও তার পত্রিকার প্রতিনিধিদের সামনে স্বীকার করে বলেন- আমি আগে করেছি নেতা-কেতা দের নিয়ে। এখন করি না। এগুলো আগের। এখন প্রমাণ করতে পারবেন না! দাম্ভিকতা দেখিয়ে মিথ্যা মামলার হুমকি দেন আর যাতে কোন সময় ইয়াবা সম্রাজ্ঞী রোজিনাকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত না হয়, এই বলে দ্রুত অফিস ত্যাগ করেন। এ ঘটনায় সোমবার (২৬ আগস্ট) পরিচালনা পরিষদের পক্ষে ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সদর মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) দায়ের করেন, যার নং ১১৯৮।

উল্লেখ্য, তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে জাতীয় দৈনিক ও লোকাল পত্রিকায় এবং অনলাইনে একাধিক সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। যা বেশ আলোচিত ও সমালোচিত হয়েছে ইয়াবা সম্রাজ্ঞী রোজিনা হিসেবে। কক্সবাজারে শহরে ‘ইয়াবা কুইন’ নামে পরিচিত। তার সাথে প্রশাসনের নানা স্তরের কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, জনপ্রতিনিধিসহ বিতর্কিত অনেকের ছত্রছায়ায় তিনি এ মাদক ব্যবসা চালিয়ে আসছে। তার বাসায় পুলিশের তিন সদস্যের সাথে হাতাহাতির ঘটনায় ওই তিন পুলিশকে গ্রেফতার ও বরখাস্ত এবং রোজিনাকেও গ্রেফতার করা হয়েছিল। জনশ্রুতি রয়েছে, কতিপয় পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যরাই বিভিন্ন অভিযানে জব্দ করা ইয়াবার চালান হতে ইয়াবা সরিয়ে রোজিনাকে দিয়ে বিক্রি করাতেন। সেই টাকার লেনদেন নিয়েই তিন পুলিশ সদস্যদের সাথে হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছিল। এরপরই তার বিত্তশালী হবার তথ্য প্রকাশ্যে আসে এবং দুদকের নজরে পড়ে। দুদক অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলাও করেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *